চিরকুট

হটাৎ করে বাসের ভাড়াটা না দিয়েই রাই বাস থেকে নামতে যাবে, কন্ডাক্টরদের ডাকে ওর সম্বিত ফিরলো। মন ভালো নেই ওর ,৫বছরের সম্পর্কের ইতি টেনে ঘরে ফিরছে। অফিস থেকে দু দিনের ছুটি নিয়েছিলো রিভুর সাথে একটা অউটিং এর জন্য। প্লান মতো সকালের ট্রেন নামখানা লোকাল ধরে শেষ স্টেশন নামখানা, সেখান থেকে ২০মিনিট এর রাস্তা, ফেজারগঞ্জ। জায়গাটায় ওরা বেশ কিছুবার গেছে, একাকিত্বে কিছুটা সময় কাটাতে। এবার এসেছিলো সম্পর্কটাকে আর একটা সুযোগ দিতে।

রাই প্লান করেছে, এইবার রিভু কে একটা surprise দেবে , ওর কাছে নিজেকে অন্য ভাবে প্রকাশ করবে, যেমনটা রিভু বারবার চাইতো আগে। শাড়ি পরবে, ঘরটা হাল্কা আলোয় ভরিয়ে দেবে, সফ্ট মিউজিক, রেড ওয়াইন, রিভুর পছন্দের ডিনার, তারপর আকাশেই দিকে তাকিয়ে দুজন দুজনের মধ্যে ডুব দেবে। অফিস থেকে ফিরে সমস্ত ক্লান্তি শোবার ঘরে রেখে রাই রিভুর জন্য অনেক কিছু বানিয়েছে। পেপার কাটিং, গ্রিটিংস, ক্রাফ্টস, একদম টাইট একটা প্লান, সমস্ত কিছু ও কলকাতা থেকেই গুছিয়ে নিয়ে যাবে, একমুহূর্ত ও নষ্ট করা যাবেনা।

পৌঁছলো দুপুর ১.৩০ নাগাদ। রিসেপশন এর ছেলেটা লাগেজ দিয়ে গেল, রাই দরজা লক করার অপেক্ষায় ছিল, দরজা লক করে ওরা নিজেদের দুটো কথা বলবে, একে অপরকে ছুঁয়ে দেখবে। কিন্তু বৃথা আশা, ভাব লেস হীন রিভু ক্লান্ত শরীরে শুয়ে পড়লো খাটের উপর। ওদের একটা বছর পর দেখা, অথচ আদর আল্লাদ দূরে থাক, রিভু রাই এর হাতটা অব্দি ধরেনি।

এটা আমার ভালোলাগে, ওটা তোকে করতেই হবে.. এসব মুখ ফুটে বলার মেয়ে রাই নয়। চোখ সরিয়ে জানালার দিকে মন দিলো, দূরে দুপুরের শান্ত সমুদ্র, পারে কেউ নেই, ডাব এর দোকানটা বন্ধ হচ্ছে, অদ্ভুত মন খারাপ চেপে ধরছে রাই কে। না না এখন মন খারাপ করার সময় নয়। ফ্রেশ হয়ে লাঞ্চ টা হোটেল এর রুম এই সারলো।পাশাপাশি শুতেই রিভুর শরীর রাই কে ছুঁলো। না আদর না, শুধুই পাশবিক তাড়না, শারীরিক খেদ, সব শেষে তৃপ্তি নয়, রাই এর নিজেকে কেমন যেন নিংড়ে নেওয়া লেবু মনে হয়।কোনো কথা না বলেই পাস ফিরে নাক ডাকতে লাগলো রিভু।

চোখ মুছে ফের শক্ত করলো মন কে।

বিকেলে সমুদ্রের ধরে কিছুক্ষন ঘোরাঘুরি করে রাই রিভুকে বল্লো, ঘরে সেলফোনটা ফেলে এসেছি, নিয়ে আসি দাড়া।
এক ছুট্টে হোটেল এর রুম এ। বেশি সময় নেই। যেমন প্লান ঠিক তেমন ভাবে লাইট, ফুল ক্যান্ডেল, ফটো, গ্রিটিংস সব সাজিয়ে ফেললো, 103 এ ফোন করে রাত্রের ডিনারটাও অর্ডার করলো। এবার ও নিজেকে সাজাবে। শাড়ি পড়লো, চোখে কাজল, খোলা চুল ইশত ভেজা, কালো টিপ আর রিভুর দেওয়া নেক পিস টা। ঘরটা অদ্ভুত রোমান্টিক হয়ে এসেছে , সঙ্গে রাই ও। হটাৎ খেয়াল হলো রিভু একবার ফোন করলো না কই, জিজ্ঞাসা করলো না কেন এত দেরি হচ্ছে!

রাই ফোন করলো রিভু কে 6-7 বার রিং হওয়ার পর ওপাশ থেকে রিভুর গলা ..কিঞ্চিৎ ঘোলাটে।
রাই-কোথায় তুই? রুম এ আই।
রিভু-নীচে বার এ আছি। এতো ঘর ঘর করলে কলকাতাতেই তো থাকতে পারতিস। আমায় পয়সা খরচ করে এখানে আনতে বল্লি কেন?
রাই-তোর জন্য একটা সারপ্রাইজ ছিল।
রিভু- ঢাম্মামো  না মেরে , ফোন রাখ…

ফোনটা কেটে গেলো, চোখ ফেটে জল এলো রাই এর । মনে ভাবল এতো কান্না পাচ্ছে কেন! রিভু তো বরাবর এরকম টাই করে এসেছে,আজ তো নতুন না।

বেলকুনিতে দাঁড়িয়ে রইলো রাই, বাতি গুলো নিভু নিভু, ঘরটা যেন কাঁদছে । চমক ভাঙলো কলিং বেল এর আওয়াজ এ। ঘড়িতে ১২.৮ , দরজা খুলতেই সেই রেসেপসান এর ছেলেটি। কোনো মতে রিভু কে ধরে ধরে এনে শুইয়ে দিল। ছেলে টি বললো -ম্যাডাম, স্যার এর বিল টা!

দীর্ঘশ্বাস, পার্স থেকে টাকা বের করার সময় রাই এর চোখে পড়লো ওর আর রিভুর সেই কলেজের ছবিটাই।
হাসি পেলো রাই এর, এবার আর কাউকে মিথ্যে করে বানিয়ে বলতে হবেনা, যে রিভু ওকে কত টা ভালোবেসেছে ,বা রাত টা কতটা সুন্দর ছিল।

দেখতে দেখতে সকাল হতেই ব্যাগ গুছিয়ে বেরিয়ে এলো রাই একাই।
একটা ছোট্ট চিরকুট রেখে গেলো রিভুর জন্য। লিখলো-

তোর প্রিয়রিটি লিস্ট এ আমার জায়গা কোনোদিনই ছিলোনা,আজও নেই। সম্পর্কটা টেনে বেড়াতে বেড়াতে আমি ক্লান্ত। বিয়ের পর ডিভোর্স কেশে এ বাদী বিবাদী হওয়ার থেকে, চল দুজন দুজনের প্রাক্তন হই।
ইতি তোর প্রাক্তন।।

— সুপর্ণা ঘোষ (০৯ সেপ্টেম্বর ২০১৭)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *