বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায় রচিত আদর্শ হিন্দু হোটেল – (রিভিউ)

বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায় রচিত উপন্যাসের অন্যতম সেরা একটি, ‘আদর্শ হিন্দু হোটেল’। বইটি পড়া শেষ করার পর বিষয়বস্তু ও গল্পের কিছু চরিত্র আমার মনে ভীষণ গভীর ভাবে দাগ কাটে। তাই ঠিক করলাম গল্পটা একটু নিজের মত করে লিখে রাখি। বেশ কয়েকটি চরিত্র থাকলেও, গল্পের প্রধান চরিত্র ‘হাজারী ঠাকুর’। ইনি একজন অত্যন্ত সাদাসিধে গরিব ব্রহ্মান, যিনি নিজের স্ত্রী ও একমাত্র কন্যা কে গ্রামে রেখে রানাঘাট শহরের রেল স্টেশন চত্বরে বেশ সুখ্যাত একটি হোটেলের রাঁধুনি বামুন এর কাজে যুক্ত হন।

অন্যান্য মুখ্য চরিত্র গুলির মধ্যে প্রথম, পদ্ম ঝি। যিনি ওই একই হোটেলের অর্থাৎ বেঁচু চক্রবর্তীর হোটেলের হত্তাকত্তা। বাবু (চক্রবর্তী মশাই) এই পদ্ম ঝির কোনো কথা ফেলেন না। দ্বিতীয় চরিত্র কুসুম, যিনি হলেন হাজারী ঠাকুরের গ্রামের এক অভাগিনী কম বয়সী বিধবা নারী। হাজারীকে জ্যাঠামশাই সম্মধন করলেও মনে প্রানে তাকে পিতার আসনে বসিয়েছে। গ্রাম বাংলার নারী চরিত্র কত খানি মমতাময়ী, ধৈর্য শীল, বিশ্বাসী ও পরোপকারী হতে পারে তার অন্যতম নিদর্শন কুসুম।

তৃতীয় চরিত্র, অতসী। হাজারীর গ্রামের অন্যতম এক ধনী পরিবারের একমাত্র কন্যা। অত্যন্ত সরল, মায়া মমতায় টইটুম্বুর তার মন। মা লক্ষীর মত মুখের গড়ন, এবং গল্পের শেষে জানা যায় তিনি একই সাথে অভাগিনীও। এছাড়াও রয়েছে বংশী, নরেন, টেপি ইত্যাদি অসংখ্য চরিত্র। বিংশ শতাব্দীর মানুষের মনুষ্যত্বের সাথে তুলনা করে এ উপন্যাস পড়লে, লেখকের লেখনীর মাধুর্য কে ছোট করা হবে। তার যুক্তি তর্কের দিকে কিছুটা পেছনে ফিরে এগোলে উপন্যাসটির সঠিক এবং শুমধুর আস্বাদন হবে বলে আমি মনে করি।

গল্পের প্রধান চরিত্র হাজারী ঠাকুর চাকরির উদ্দেশ্যে গ্রাম ছেড়ে শহরে আসে, এবং চাকরী নেয় বেঁচু চক্রবর্তীর হোটেলে। সেখানে হাজারী ছাড়াও ছিল আর একজন ঠাকুর, বংশী, পদ্ম ঝি ও আরো তিন চার জন চাকর। হোটেলটি খানিকটা এরকম, ঢুকতেই বাম হাতে গদির ঘর, তারপর খাবার ঘর। সেখানে আছে তিন ধরনের মিলের ব্যবস্থা। ফার্স্ট ক্লাস, সেকেন্ড ও থার্ড ক্লাস। গদিতে টিকিট কেটে খাবার ঘরে ঢোকার ব্যবস্থা। খাবার ঘরের ঠিক পেছনে রান্নার জায়গা, যা ছিল হাজারী ঠাকুরের জন্য স্বর্গ সমান। রান্নার গুনে তিনি ছিলেন লোক মুখে প্রসিদ্ধ। তার নিরামিষ তরকারি ও মাংস রান্নার নাম ছড়িয়ে পড়ে দূর দুরান্তে। সকলের কাছে প্রশংসা জুটলেও পদ্ম ঝি, ও চক্রবর্তী বাবু মুখ ফুটে কক্ষনো সে কথা বলেনি। গত সাত বছর হাজারী মাত্র ৮ টাকার চাকরি করে স্ত্রী ও কন্যার অন্ন জোগাড় করে চলেছে।

হোটেলের কিছু দূরেই কুসুমের শ্বশুর বাড়ি। স্বামী তার গত হলেও শাশুড়ির কাছেই দুই সন্তান নিয়ে সে দুধ দই বিক্রি করে কোনো রকমে সংসার চালায়। হাজারী ঠাকুরের ভারী মায়া পরে যায় কুসুমের উপর। তিনি কুসুম কে নিজের মেয়ে টেপির থেকে কিছু মাত্র আলাদা করতে পারেন না। হোটেলে কখন কোন ভালোমন্দ রান্না হলেই, পদ্ম ঝির হাজার মুখ ঝামটা শুনেও নিজের ভাগ টুকু কুসুমের বাড়ি পৌঁছে দিয়ে তারপর সন্তুষ্ট হতেন। পিতৃহারা কুসুমও জেঠামোশাই এর আদর যত্ন, মমতা বিশ্বাস, ভরসা, কোন ক্ষেত্রেই কোন অভাব রাখেনি।

গল্পের মাঝে দেখা যায়, নিজের শেষ সম্বল টুকু পর্যন্ত হাজারী ঠাকুরের হাতে তুলে দিতে দুইবার ভাবেনি। হোটেলের রান্না শুরু হয় ভোর থেকেই। প্রথমে দুধ তারপর ভাতের জল, বড় ডেকচিতে ডাল, বাজার থেকে আসা সবজী, মাছ সমস্তই হয় পদ্ম ঝির কথা মত। এই পদ্ম ঝি চরিত্রটি লেখকের এক অদ্ভুত রূপায়ণ। বিধবা মহিলা, গলার আওয়াজ ও মুখের ভাষায় সে মারিতং জগৎ। বেচু চক্রবর্তী হোটেলের মালিক হলেও আপাত দৃষ্টিতে দেখে যে কেউ বলবেন পদ্ম ঝি মালিক থেকে কিছু কম না। হাজারী ঠাকুর কে সে এক চক্ষে সহ্য করতে পারেনা। এছাড়াও তার আরো কিছু বদ গুন ছিল, যেমন চুরি বিদ্যা ও মিথ্যা বলা। বেশির ভাগ সময়ই তার মিথ্যা চাপা পড়ে যেত তার বাজখায়ি গলার আওয়াজ এ।

হাজারীর বহুদিনের ইচ্ছে তার নিজের এক খানি হোটেল খোলার। এই সাত বছর সে খুব মন দিয়ে হোটেলের খুঁটিনাটি সমস্ত কাজ দেখে দেখে শিখেছে। তার দৃঢ় বিশ্বাস সে হোটেল খুললে, ব্যবসায় সে অনেক উন্নতি করবে। প্রত্যহ কাজ শেষে সে খোলা চোখে এই স্বপ্ন দেখতে থাকে। কিন্তু হাজারী গরিব, হোটেল খুলতে চাই ২০০ টাকা। তাই দু চোখে স্বপ্ন নিয়েই জীবন স্রোত এগিয়ে চলে।

একদিন হঠাৎ বেচু চক্রবর্তীর হোটেল থেকে চুরি যায় বেশ কিছু বাসন। দোষ গিয়ে পড়ে হাজারী আর বংশির উপর। চোর বদনাম নিয়ে তার চাকুরী যায়। বেকারত্বের বোঝ নিয়ে যাযাবরের মত বেশ কিছুদিন এ গ্রাম সে গ্রাম ঘুরে অবশেষে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে রান্নার ঠাকুরের কাজ নেয় হাজারী। খুব অল্প দিনেই হাজারী, রান্নার গুনে বাড়ির মেয়ে বউ দের বড় প্রিয় হয়ে ওঠেন। কিন্তু সে গ্রামে তার মন টিকতে চায়না। সেখানে দুবেলা পেট ভরা ভাত, আবার উপরি জল খাবার, সাথে ভাল মাইনের কিন্তু হাজারীর মন পড়ে রয় সেই বেচু চক্রবর্তীর হোটেলে। মাইনে পেয়ে হাজারী নিজ গ্রামে যায়, এবং এখানে আবির্ভাব লেখকের রচিত অপর একটি চরিত্র অতসী। সে হাজারীর ইচ্ছের কথা জানতে পারে এবং তাঁকে সাহায্য করতে চায়। হাজারী তার থেকে টাকা নিতে অস্বীকার করলেও অতসী একরকম জোর করেই সে টাকা হাজারী কে দেয়। গল্প এগোতে থাকে। রানাঘাটে হোটেলের জন্য জায়গা জমি দেখতে এসে হাজারী পুরোনো মনিবের সাথে সাক্ষাৎ করে, হটাৎ সেই পুরোনো জায়গা, পুরোনো মনিবকে দেখে হাজারীর মনে সেই আগের মতোয় এক অদ্ভুত সম্ভ্রমের উদয় হয় এবং পুনরায় কাজে নিযুক্ত হয়।

হাজারী না থাকায় হোটেলের খরিদ্দার কমেছে, বেঁচু চক্রবর্তী তাই নিজে তাকে ডেকে কাজে বহাল করেন। হাজারিও আনন্দে যোগ দেয়। সে হোটেল যেন তার কাছে নিজের হাতে বানানো সংসার। যথারীতি পদ্ম ঝি বিরক্ত হলেও বলতে পারেনা কারণ হাজারী চলে যাওয়ার পর বেঁচু চক্রবর্তীর হোটেলের হাল বেশ কিছুটা বেহালি হয়ে পরে। কিছু দিন কাটতে না কাটতেই ফের পদ্ম ঝির কাছে অপমানিত হন হাজারী এবং তারপরই নিজের হোটেল খোলার সিদ্ধান্ত নেয়। কুসুম ও অতসীর টাকা লাগান সে কাজে এবং লাভের অংশ তাদের দেয়ার ব্যবস্থা করলেন। হটেলের নাম দেওয়া হল “আদর্শ হিন্দু হোটেল” যেখানে হাজারী ঠাকুর নিজে হাতে রান্না করে খাওয়ান। এই পর আস্তে আস্তে হাজারী এ ব্যবসায় বেশ উন্নতি করে। বংশির এক ভাগ্নে নরেন কে রাখা হয় ম্যানেজার হিসেবে। হাজারীর তাকে দেখে ভারী ভালোলাগে। যেমন সুন্দর চেহারা, তেমন কাজের, তাই তিনি নরেনের সাথে টেপির বিয়ে দেওয়ার কথা ভাবেন। ইতি মধ্যে হাজারীর হোটেল তেমনি নাম ডাক করে ও বাকি সমস্ত হোটেল একরকম বাজার খুইয়ে বন্ধ হয়ে যাওয়ার জোগার হয়। গ্রাম থেকে হাজারী ঠাকুরের স্ত্রী ও মেয়ে আসে রানাঘাটে। এই খানে হটাৎ পদ্ম ঝির চরিত্রে এক অন্যরকম পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। সে হটাৎ হাজারীর উদ্দেশ্যে সম্মান পূর্বর আচরণ করে, যা হাজারীর চিন্তারো অধিক ছিল। সে জানতে পারে পদ্ম ঝি তার জীবনের শেষ সম্বল টুকুও ওই বেচু চক্রবর্তীর হাতে তুলে দেয় এই হোটেল দ্বার করানোর জন্য। আজ তার ঘটি বাটি সব গেছে, শেষ অবধি হোটেলটাও রক্ষা না পাওয়ার আশঙ্কায় চোখে জল এসে তার। হাজারীর ভারী কষ্ট হয় পদ্ম ঝির জন্য।

এমতাবস্থায় স্টেশন প্লাটফর্মে আর একটি হোটেল খোলার খবর ছড়িয়ে পরে। হাজারী কে ডেকে স্টেশন মাস্টার সমস্ত কাগজ পত্র তৈরি করে তাকে রাজি করান স্টেশন এর হোটেলটিও তাকে দিয়ে করানোর জন্য। হাজারী রাজি ও হয়। স্টেশন চত্তরের প্রায় সকল হোটেল মালিকই সে হোটেল এর পারমিশন এর আশায় বেশ কিছু টাকা করি ও খরচা করেন, কিন্তু শেষ অব্দি তা হাজারীর কপালেই জোটে। যেমনি তার খাবারের নাম, রান্নার সুখ্যাতি, তেমনি তার আতিথেয়তা ও ব্যবহার। শেষ বয়সে ভগবানে অশেষ বিশ্বাস ও কঠোর পরিশ্রমে হাজারী তার নিজের পরিবারের ও কুসুমের মুখে হাসি ফুটিয়ে তোলে। এর পর হঠাৎ একদিন তার হোটেলে খেতে আসেন বোম্বে থেকে কয়েকজন বাবু। তারা খাওয়া দাওয়া করে হাজারী কে ডাকে এবং জানায় হাজারীর জন্য বোম্বে তে একটি চাকরির কথা। হাজারী রাজি হয়ে যায়। ১৫ দিনের মাথায় রওনা দিতে হবে তাই একরকম তাড়াহুড়ো করে নরেনের সাথে বিয়ে দেয় টেপির। টেপির বিয়ের উদ্দেশে অতসী কে নেমন্তন্ন করা হয়, সে আসলে তাকে দেখে হাজারী ভীষণ রকম ধাক্কা পায়। তার দেখা মা লক্ষীর গায়ে উঠেছে সাদা কাপড়। এদিকে বেচু চক্রবর্তী ও পদ্ম ঝি হোটেল খুইয়ে রাস্তায় এসে বসার জোগাড়, দেনার দায়ে তাদের হোটেল নিলামে উঠেছে। সেই মুহূর্তে কোনো কিছু না চিন্তা করে হাজারী বেচু চক্রবর্তী কে তার হিন্দু হোটেলের ম্যানেজার ও পদ্ম ঝির হাতে সমস্ত দেখা সোনার দায়িত্ব তুলে দেয়। চাকরীর উদ্দেশ্যে বেরোনোর ঠিক আগে পদ্ম ঝি হটাৎ হাজারী ঠাকুর কে প্রণাম করে, সকলের স্বজল চোখ ও আকুতি এড়িয়ে গেলেও পদ্ম ঝির এই আচরণ যেন হাজারীর মনে সর্ব প্রাপ্তির ভাব এনে দেয়। সেই পদ্ম দিদি যে কোনোদিনো তার সুনাম করেনি, তাকে দু চোখে সহ্য করতে পারেনি, খারাপ মন্তব্য করেছে, সোজা মুখে কথা বলেনি, সে আজ তাকে প্রণাম করেছে। এই একটুকরো সম্মানে হাজারীর মন প্রাণ ভরে ওঠে। এ যেন তার জীবনের শ্রেষ্ঠ পাওয়া।
Buy Adarsha Hindu Hotel (Bengali) by Bibhutibhushan Bandyopadhyay online

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *